কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি উত্থান পতন

কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি। পুরো নাম মুয়াম্মার আবু মিনার আল গাদ্দাফি। কারও কাছে তিনি একনায়ক, স্বৈরশাসক। কারও কাছে অতি জনপ্রিয় ‘ব্রাদারলি লিডার’। দীর্ঘ প্রায় ৪২ বছর তিনি এক হাতে শাসন করছেন উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া। একনায়ক হলেও এর মধ্যে তিনি দেশে ও বিদেশে কুড়িয়েছেন সুনাম। আবার তাকে নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। ১৯৪২ সালের ৭ই জুন সিতর এলাকার কাছে একটি বেদুইন পরিবারে তার জন্ম। কিশোর বয়সেই তিনি ছিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের ভক্ত ও তার আরব সমাজবাদের ভক্ত। জাতীয়তাবোধের আদর্শে তিনি উজ্জীবিত। ১৯৫৬ সাল থেকে তিনি ইসরাইলবিরোধী অবস্থান নেন। ১৯৬৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর জুনিয়র একটি দলকে নিয়ে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করেন বাদশা ইদ্রিসকে। ওই সময় বাদশা ইদ্রিস চিকিৎসার জন্য ছিলেন তুরস্কে। এর পর বাদশার ভাইপো যুবরাজ সাঈদ হাসান অর রিদা আল মাহদিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় একদল বিপ্লবী সেনা কর্মকর্তা। রিদা আল মাহদিকে করা হয় গৃহবন্দি। এভাবে মুয়াম্মার গাদ্দাফির নেতৃত্বে লিবিয়া রাজতন্ত্র মুক্ত হয়। লিবিয়াকে ঘোষণা করা হয় ‘লিবিয়ান আরব রিপাবলিক’। তখন গাদ্দাফির বয়স মাত্র ২৭ বছর। সাফারি স্যুট ও সানগ্লাস পরা গাদ্দাফি যেন হয়ে ওঠেন আরেক চে গুয়েভারা। এর মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ওঠে পশ্চিমাবিরোধী একটি শক্তি। ১৯৭০ সালে তিনি লিবিয়া থেকে ইতালিয়ানদের তাড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। এর ফলে লিবিয়া থেকে ইতালীয়রা প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। এমন সময় দেশ চালাতে গঠন করা হয় রেভ্যুলিউশনারি কমান্ড কাউন্সিল। এর চেয়ারম্যান করা হয় গাদ্দাফিকে। ১৯৭০ সালে তার নামের সঙ্গে যোগ করা হয় প্রধানমন্ত্রী খেতাব। তবে সেই পদে তিনি বেশি দিন থাকেননি। ১৯৭২ সালেই ওই খেতাব বাদ দেন। অন্য সামরিক বিপ্লবীদের মতো গাদ্দাফি ক্ষমতা দখল করেও নিজেকে জেনারেল হিসেবে ঘোষণা দেননি। তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন। ক্ষমতা দখল করার পর সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে তিনি কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। তার পর থেকে তিনি সেই কর্নেল পদেই বহাল ছিলেন। একজন কর্নেল দেশ শাসন করেন এমন ঘটনা পশ্চিমা দুনিয়ায় বিরল। গাদ্দাফি তার দেশের জন্য একটি স্লোগান চালু করেন। তা হলো লিবিয়া ‘জনগণ কর্তৃক পরিচালিত’। এজন্য সাড়ম্বরে তার কোন পদবি দরকার হয়নি। সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ তার দরকার হয়নি। ১৯৭৭ সালে তিনি ঘোষণা দেন লিবিয়া তার সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনছে। প্রজাতন্ত্র থেকে লিবিয়া পরিণত হচ্ছে জামাহিরিয়ায়। এর অর্থ লিবিয়া হলো জনমানুষের সরকারের দেশ। বাস্তব অর্থে লিবিয়া পরিণত হয় গণতান্ত্রিক সরকারের দেশে। জনগণই এর শাসক। এজন্য গঠন করা হয় বিভিন্ন কাউন্সিল ও স্বশাসিত ক্ষুদ্রতম এলাকা। আর সব কাঠামোর ওপরে রাখা হয় জেনারেল পিপলস কংগ্রেস। এর সেক্রেটারি জেনারেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি। কিন্তু দুই বছর পরই গাদ্দাফি সরকার থেকে তার পদ ত্যাগ করেন। দেশকে দেন সমঅধিকারের দর্শন। মাঝেমধ্যেই তিনি অভ্যন্তরীণ ও অন্য দেশের বিষয়ে কঠোর মন্তব্য করেন। বিদেশে বসবাসকারী ভিন্নমতাবলম্বী লিবিয়ানদের ১৯৮০ সালের এপ্রিলে হত্যা করার আহ্বান জানায় তার রেভ্যুলিউশনারি কমিটি। এজন্য লিবিয়ার হিট স্কোয়াডকে বিদেশে পাঠানো হয় তাদেরকে হত্যা করার জন্য। ১৯৮০ সালের ২৬শে এপ্রিল গাদ্দাফি ওইসব ভিন্নমতাবলম্বীকে দেশে ফিরে আসার জন্য ১৯৮০ সালের ১১ই জুন পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেন। বলা হয়, তারা দেশে ফিরে না গেলে তুলে দেয়া হবে রেভ্যুলিউশনারি কমিটির হাতে। ওই সময়ে হত্যা করা হয় মোট ৯ লিবিয়ানকে। এর মধ্যে ৫ জনকে হত্যা করা হয় ইতালিতে। মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের আরব দর্শনের তিনি ছিলেন ভীষণ ভক্ত। একই সঙ্গে তিনি আরব রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে এক আরব গঠনের জোর পরামর্শ দেন। ১৯৭০ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর জামাল নাসের মারা যান। কিন্তু তার আদর্শের শিখা জ্বালিয়ে রাখেন গাদ্দাফি। তিনি ১৯৭২ সালে ‘ফেডারেশন অব আরব রিপাবলিকস’ ঘোষণা দেন। এর মাধ্যমে তিনি একটি একীভূত আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশা করেছিলেন। কিন্তু সে আহ্বানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তিনটি দেশ। ফলে একীভূত আরব গঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এ লক্ষ্যে তিনি ১৯৭৪ সালে তিউনেসিয়ার হাবিব বারগুইবার সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু সে উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। আউজোউ উপত্যকা নিয়ে প্রতিবেশী দেশ চাদের সঙ্গে লিবিয়ার বেশ কয়েকবার উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। লিবিয়া ওই উপত্যকা দখল করে ১৯৭৩ সালে। আপত্তি ওঠে তা নিয়েই। এ নিয়ে একবার যুদ্ধও হয়েছে। পরে তা ১৯৮৭ সালে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শেষ হয়। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের ১৯৯৪ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারির এক রায়ের ফলে চাদ থেকে লিবিয়া সেনাদের প্রত্যাহার করে নেয়। গাদ্দাফি ফিলিস্তিনের ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’-এর একজন ভক্তে পরিণত হন। তবে পশ্চিমাবিরোধী নীতির কারণে গাদ্দাফিকে পশ্চিমারা সব সময়ই নেতিবাচক চোখে দেখেছে। কূটনৈতিক অঙ্গনেও তার প্রতি দৃষ্টি তেমনই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সময় লিবিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্কে টান টান উত্তেজনা দেখা দেয়। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে গাদ্দাফির আপসহীন অবস্থানের কারণে ওই সময় পশ্চিমা শক্তিগুলো মিলে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করে। রোনাল্ড প্রশাসন লিবিয়াকে একটি ‘যুধ্যমান বদমাশ রাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করে। রোনাল্ড রিগ্যান নিজেই গাদ্দাফিকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের পাগলা কুকুর’ বলে অভিহিত করেন। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার নাগরিকদের লিবিয়া সফর বাতিল করতে তাদের পাসপোর্ট অকার্যকর করে দেয়। ১৯৮২ সালের মার্চে লিবিয়ার তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে লিবিয়ার তেল শিল্পে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ১৯৮৪ সালে গাদ্দাফিবিরোধী এক র‌্যালিতে দায়িত্ব পালনের সময় লন্ডনে অবস্থিত লিবীয় দূতাবাসের বাইরে বৃটিশ কনস্টেবল ইভোনি ফ্লেচারকে গুলি করা হয়। এতে কয়েক দশক বৃটেনের সঙ্গে লিবিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন থাকে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গাদ্দাফিকে হত্যার চেষ্টা চালায় বৃটেনের গোয়েন্দা সার্ভিস। ওই সময় তির শহরের কাছে তার মোটর বহরে হামলা চালানো হয়। ওই অভিযানকে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবিন কুক একটি ‘খাঁটি ফ্যানটাসি’ বলে বর্ণনা করেন। ২০০৯ সালে স্কটল্যান্ডের লকারবি বোমা হামলায় অভিযুক্ত মেগরাহিকে দেশে স্বাগত জানান গাদ্দাফি। ২০০৯ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেন তিনি। সেখানে বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। আস্তে আস্তে একের পর এক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকেন তিনি। গত ২৩শে আগস্ট বিদ্রোহীরা তার বাব আল আজিজিয়া প্রাসাদ দখল করে নেয়। সেখান থেকে তার আগেই পালিয়ে যান মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও তার পরিবারের সদস্যরা। এর মধ্য দিয়েই মূলত গাদ্দাফির পতন ঘটে। তারপরও তার অনুগতরা লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। সর্বশেষ তারা তার জন্মশহর সির্তে অভিযান চালায়। সেই অভিযানেই গতকাল গুলিবিদ্ধ হন গাদ্দাফি।
Share on Google Plus

About Fenchuganj Barta (সাপ্তাহিক ফেঞ্চুগঞ্জ বার্তা)

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন